1. maniknews1980@gmail.com : editor :
  2. jalshahina@gmail.com : news.editor : moslahnur rahman chowdhury
  3. admin@bidrohinews24.com : admin :
মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০২৪, ০২:৩৮ অপরাহ্ন

স্বপ্নের সৌদি আরবে ক্যাম্পবন্দি প্রবাসীদের জীবন

  • Time বুধবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২২
  • ১১৬ Times

বিদেশে গেলেই ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। ধরা দেবে স্বপ্নের সোনার হরিণ। এমন আশায় বিদেশে গিয়ে কারও কারও জীবন বন্দি ক্যাম্পের চার দেয়ালের মধ্যে।

সম্প্রতি সৌদি আরবে গিয়ে এমন অভিজ্ঞতায় পড়েছেন অনেক বাংলাদেশি। ক্যাম্পের মধ্যেই কাটছে তাদের দিন-রাত্রি।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের হিসেব অনুযায়ী, গত ছয় মাসে ৩২ হাজারের বেশি মানুষ সৌদি আরব থেকে ফেরত এসেছেন। চুয়াডাঙ্গার ওসমান আলী ভাগ্য বদলের আশায় পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে গেছেন সৌদি আরব। সোমবার তার ছয় মাসের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়। এখনও যোগ দিতে পারেননি কাজে। ক্যাম্পের মধ্যেই কাটছে তার সময়। মাঝে কয়েকদিন সুইপারের কাজ করলেও পেয়েছেন পাঁচ-ছয়শ রিয়াল।

ক্যাম্পবন্দি জীবনের কথা বলতে গিয়ে ওসমান বলছিলেন, “কখনও খেয়ে, কখনও না খেয়ে দিন কাটছে। খুবই কষ্টে আছি ভাই। কেউ না দেখলে বুঝবে না কতটা কষ্টে কাটছে দিন। আমাদের ক্যাম্পে দুইশ’ জনের মতো বাংলাদেশি আছেন। যখন এখানে আর ধরে না তখন কাউকে কাউকে অন্য ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এদের অনেকগুলো ক্যাম্প আছে। কেউ ছয় মাস, কেউ আট মাস, কেউবা চার-পাঁচ মাস ধরে আছেন। কাজ জুটছে না। এত টাকা খরচ করে বিদেশে গিয়ে কিভাবে খালি হাতে ফিরব? ভাই আমরা অনেক কষ্টে আছি।”

ক্যাম্প থেকে মুক্ত হতেও লাগে টাকা
সৌদি আরবে এই শ্রমিকদের পাঠিয়েছে ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি রিক্রুটিং এজেন্সি। চার লাখ টাকা দিয়ে চার মাস আগে সৌদি আরব গেছেন গাজীপুরের কোনাবাড়ির নজরুল ইসলাম। তার স্ত্রী পারভীন আক্তার একটি গার্মেন্টে চাকরি করেন।

তিনি বলেন, “আড়াই লাখ টাকা এনজিও থেকে ঋণ করে, নিজের গহনা বিক্রি করে আর জমানো টাকা দিয়ে স্বামীকে বিদেশে পাঠিয়েছি। ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনালের এমডি মোশায়েদ হাসানের কাছেই এই টাকা দিয়েছি। চার মাস ক্যাম্পে রেখেও তারা যখন চাকরি দিচ্ছিল না, তখন সেখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেন আমার স্বামী। এর জন্যও ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা নাসির হোসেনকে ৩৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। এখন চাকরির খোঁজে আমার স্বামী সেখান থেকে বেরিয়ে গেছেন। স্বামী চাকরি না পেলেও প্রতি মাসে এনজিওর ঋনের কিস্তি দিতে হচ্ছে। কীভাবে দিচ্ছি তা একমাত্র আল্লাহ জানেন। ৫ বছরের ছেলেকে নিয়ে এখন আমাদের খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে।”

একই কোম্পানির মাধ্যমে গত ৭ জুলাই সৌদি আরব গেছেন মুজিবর রহমান। তাকেও কোনো কাজ দেওয়া হয়নি। ক্যাম্পেই খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে তার।

বিষয়টি পরিবারকে জানালে তার চাচাতো বোন তাফসিনা ইয়াসমিন যোগাযোগ শুরু করেন। তিনি বিষয়টি জানিয়ে একই সঙ্গে ই-মেইল করেন সৌদি আরবে বাংলাদেশের দূতাবাস, জনশক্তি কর্মসংস্থান প্রশিক্ষন ব্যুরো (বিএমইটি), পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব জায়গায়। পুলিশ নিয়ে হাজির হন রিক্রুটিং এজেন্সির অফিসে। এতসব তৎপরতার পর মুজিবরের আকামা করে দেয় এজেন্সি। তারপরও কাজ দেয়নি।

তার অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২৩ আগস্ট শুনানির আয়োজন করে বিএমইটি। সেখানে এজেন্সির প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। শুনানি গ্রহণ করেন বিএমইটির উর্ধ্বতন পরিসংখ্যান কর্মকর্তা মাসুদ রানা।

তাফসিনা ইয়াসমিন অভিযোগ করেন, “শুনানির শুরুতেই আমার সার্বিক অভিযোগ আমলে না নিয়ে আমার ভাইয়ের বিষয়টি সমাধানের কথা বলেন তারা। তাদের বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে, আমি অভিযোগ করে ভুল করেছি। আমি অভিযোগ করেছি, এই এজেন্সি গত এক বছরে যাদের সৌদি আরব পাঠিয়েছে তাদের একজনকেও চাকরি দিতে পারেনি। সেখানে এজেন্সির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো আমাকেই বলা হলো, সার্বিক বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য তারা শুনবেন না। শুধু আমার ভাইয়ের বিষয়ে কিছু বলার থাকলে যেন বলি। তখন আর কী করা? আমি বললাম তারা যেন আমার ভাইকে ছেড়ে দেয়, আমি অন্য কোথাও চাকরির ব্যবস্থা করব। সেভাবেই তারা অভিযোগের নিষ্পত্তি করে দিলো।”

“এই প্রতিষ্ঠানটির পাঠানো মানুষগুলো গত এক বছরে এক টাকাও রেমিটেন্স পাঠায়নি। তাহলে তারা কীভাবে লোক পাঠাচ্ছে, সেই প্রশ্নটি আমি তাদের করেছিলাম। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর জানার আগ্রহ নেই বিএমইটির কর্মকর্তাদের।”

জানতে চাইলে বিএমইটির ঊর্ধ্বতন পরিসংখ্যান কর্মকর্তা মাসুদ রানা ডয়চে ভেলেকে বলেন, “তারা নিজেরাই আলোচনা করে একটা সমঝোতায় এসেছেন। আমরা সেটা বাস্তবায়ন করে দিয়েছি। উনি সমঝোতা না করলে আমরা আমাদের মতো সিদ্ধান্ত নিতাম। সেই সুযোগ তো তিনি দেননি। বরং তিনি অভিযোগের নিষ্পত্তি করে গেছেন।”

প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধাররা মানবপাচার ও জিম্মির মাধ্যমে অর্থ আদায়ের অভিযোগে গত ১৯ মে গ্রেপ্তার হন ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশায়েদ হাসানসহ (২৬) পাঁচ কর্মকর্তা। অন্যরা হলেন, গোলাম আজম সৈকত (৪২), মেহেদী হাসান শান্ত (২৩), মোহসিন হোসেন (২৬) ও নাইফ উদ্দিন রুদ্র (২০)। পল্টন থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

পরে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তথ্য-প্রমাণ পাওয়ায় পল্টন থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এই পাঁচজন এবং সৌদি আরবে অবস্থানরত এই চক্রের আরেক সদস্য (ক্যাম্পের দায়িত্বপালনকারী) মো. নাসির উদ্দিনসহ (৫০) মোট ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়।

পরে তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।

মামলার বাদী পলি আক্তার লিজা অভিযোগ করেন, তার স্বামী কামরুল আহসান এবং সঙ্গে আরও পাঁচজনকে কাজের চুক্তিতে সৌদি আরবে পাঠায় ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল। যাওয়ার সময় জোর করে তাদের ব্যাগে চার-পাঁচ কেজি জর্দা দিয়ে দেয় প্রতিষ্ঠানটির লোকজন। কিন্তু সৌদি আরবে যে কোম্পানির জন্য পাঠানো হয়, তারা তাদের গ্রহণ করেনি। তবে চক্রের সদস্য মো. নাসির উদ্দিন গ্রহণ করে একটি ক্যাম্পে নিয়ে যান।

এরপর দীর্ঘদিন সেই ক্যাম্পে তাদের আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। সেই সঙ্গে দাবি করা হয় মোটা অংকের টাকা। স্বামীকে নির্যাতন থেকে বাঁচাতে কিছু টাকাও দেন তিনি। পাশাপাশি ওই ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনালের মালিক এবং কর্মকর্তাদের বিষয়টি সমাধানের জন্য জানান। কিন্তু তারা সমাধান না করে উল্টো টাকা না দিলে নির্যাতন চলবে বলে হুমকি দেন। বাধ্য হয়ে তিনি মামলা দায়ের করেন।

কয়েকদিনের মধ্যেই জামিনে মুক্তি পেয়ে বাদীর সঙ্গে সমঝোতা করে ফেলেছে প্রতিষ্ঠানটি।

ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশায়েদ হাসান বলেন, “ভুল বোঝাবুঝির কারণে মামলাটি হয়েছিল, বাদির সঙ্গে আমাদের সমঝোতা হয়ে গেছে।”

গত এক বছরে ৭০০ থেকে এক হাজার মানুষকে তারা সৌদি আরব পাঠিয়েছে দাবি করে মোশায়েদ হাসান বলেন, “আমরা যাদের পাঠিয়েছি, তারা অধিকাংশই ভালো আছে। দু’একজনের সমস্যা হলে সমাধান করে দিচ্ছি।”

ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামেও আসছে ওয়ার্ক পারমিট
সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর রেজা ই রাব্বি সাম্প্রতিক সংকটের কথা স্বীকার করেছেন।

তিনি বলেন, “আগে আমাদের জানতে হবে সমস্যার মূলটা কী? সমস্যার মূলে হচ্ছে করোনার সময় সৌদি আরবে ছোট, বড়, মাঝারি অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। পরবর্তীতে সৌদি সরকার উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে কোম্পানী খোলা এবং ঋণ প্রাপ্তি সহজ করেছে। মাত্র এক হাজার ১৫০ রিয়েল দিয়েই ঘরে বসে অনলাইনে একটা কোম্পানি খোলা যায়। এর ফলে গত বছরের এপ্রিল থেকে গত মার্চ পর্যন্ত এক বছরে এক লাখ ২ হাজার কোম্পানি নিবন্ধিত হয়েছে। এই কোম্পানিগুলোর কোনো কাজ নেই। তারা অপেক্ষায় আছে কোন প্রজেক্টে সাপ্লাইয়ের কাজ পাওয়ার জন্য। এরাই বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে ভিসা দিচ্ছে। এর মধ্যে আবার এখানে সৌদিকরণ চলছে। এটা এমন যে, কোন কোম্পানিতে ৩০% সৌদি নাগরিককে নিয়োগ দিতে হবে। তা না হলে ওই কোম্পানিকে রেড ঘোষণা করা হচ্ছে। এর ফলে তারা কোনো কাজ পাবে না। এদের কোন কর্মীকে আকামা দেওয়া হবে না। আবার এখানে কর্মীদের ওয়ার্ক পারমিট রিনিউ করতে ১২ থেকে ১৩ হাজার রিয়াল খরচ হয়। এই বিপুল টাকা তারা এখন দিতে পারছে না। ফলে কর্মীরা বেকার হয়ে যাচ্ছে এবং দেশে ফিরতে বাধ্য হচ্ছে।”

এর মধ্যেও তাহলে নতুন মানুষ কীভাবে যাচ্ছেন? তাদের আটকানো হচ্ছে না কেন? জানতে চাইলে রাব্বি বলেন, “আমরা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। যারা আসছে তারা যেন চেক করে আসে। এত মানুষকে একমোটেডে করার সুযোগ এখানে নেই। গত পাঁচ-ছয় বছরে ২৫ লাখ কর্মী এখানে এসেছে। কিছু অসাধু এজেন্সি ফ্রি ভিসার নামে আনছে। এখন এখানে কেউ স্পন্সরের বাইরে কাজ করতে পারে না। এখানে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করার সুযোগ নেই। ফলে কিছু এজেন্সি শুধু লোক পাঠিয়ে উপার্জনের ধান্দা করছে।”

সংকটময় এই পরিস্থিতিতে বিএমইটি কী করছে? জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক শহীদুল আলম বলেন, “বর্তমানে দু’একটি কোম্পানি, যাদের নিজেদের কারখানা নেই, তারা অন্য কোম্পানিতে সাপ্লাই দিতে লোক নিচ্ছে। এই অনুমতিটা সেই দেশের ব্যাপার। ভিসা পাওয়াটাও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। নিয়োগকারী দেশের যদি ইচ্ছে থাকে কাজ ছাড়াও কর্মী আনা যাবে, তাহলে সেটা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জের। এখন এখান থেকে তো বোঝা মুশকিল কে মূল কোম্পানি আর কে সাপ্লায়ার? এটা নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে এসেছে।”

যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তাদের ব্যাপারে বিএমইটি কী করছে? জানতে চাইলে আলম বলেন, “কেউ ফিরে আসলে ফৌজদারি বা দেওয়ানি মামলা করতে পারে। এমনকি সচিব বরাবর ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করতে পারেন। আমরা তখন আইনগতভাবে তাদের প্রতিকার দেব। তবে যারা যাচ্ছেন তাদেরও যাচাই বাছাই করে যেতে হবে। তারও কিছু দায়িত্ব আছে। এখন বিশ্বব্যাপী যে রেমিটেন্স বা বৈদেশিক মুদ্রার হিমশিম অবস্থা, সেখানে আমরা যদি প্রমোট না করে কন্ট্রোল করতে যাই হয়ত কিছু মানুষের আপাত ভালো হতে পারে। কিন্তু মূল স্রোতধারা বাধাগ্রস্থ হয়, এমন কিছু করার সময় এখন না। এখন যারা বাইরে যাচ্ছে তাদের কিছু মানুষের সমস্যা হলে সেটারও সমাধান করতে হবে।”

এই বিভাগের আরও খবর
চৌধুরী মিডিয়া গ্রুপ এর একটি প্রকাশনা © All rights reserved
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: FT It